ডেস্ক রিপোর্ট : লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব আয়োজিত একুশে ফেব্রুয়ারির আলোচনায় বক্তারা বলেন- প্রবাসে মাতৃভাষা চর্চা আরও সুদৃঢ় করতে এবং মাতৃভূমির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মেলবন্ধন তৈরি করতে ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালি পরিবারে বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি চর্চায় নিবিড় মনোযোগ ছেলে মেয়েদের মেধা বিকাশের জন্যও বিশেষ সহায়ক।
ছেলে মেয়েদের বাংলা শেখাতে ঘরে ঘরে বাংলা চর্চার আহবান জানিয়ে বক্তারা বলেন- বাংলা শেখার কাজটি মা বাবাদেরকেই করতে হবে। আমরা নিজেদের ঘরে ছেলে মেয়েদের সাথে যতবেশি বাংলায় কথা বলবো, ততই তারা বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠবে।
২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে ‘অমর একুশ-অহংকারের ৭০ বছর’ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ আয়োজনে আলোচনার পাশাপাশি ছিলো আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠান।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী।
তিনি তাঁর সূচনা বক্তব্যে বিলেতে বাংলা ভাষার বিকাশে কমিউনিটি সংবাদপত্রের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন ভবনের দেয়ালে আলোর ঝলকানিতে আমরা উচ্ছসিত হই অথচ সেই ভবনের ভেতরেই আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে- উল্লেখ করে তিনি বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে বাংলা ভাষা চর্চার দুরাবস্থার দিকেই ইঙ্গিত করেন।
ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক তাইসির মাহমুদ এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে “বিলেতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ” শীর্ষক মূল আলোচনা তুলে ধরেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ভাষা সমন্বয়ক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক ডঃ মোঃ আব্দুল হান্নান।
তাছাড়া “বিলেতে বাংলা-চর্চায় মিডিয়ার ভুমিকা” শীর্ষক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রযোজক সাংবাদিক ও লেখক মিজানুর রহমান খান, চ্যানেল এস’র অনুষ্ঠান প্রধান ও ‘সুন্দর করে বাংলা লিখি’ প্রোগ্রামের প্রযোজক ফারহান মাসুদ খান এবং টিভি ওয়ান-এর ‘বাংলায় কথা বলি’ অনুষ্ঠানের প্রযোজক ও উপস্থাপক জিয়াউর রহমান সাকলাইন।
এছাড়াও অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে বায়ান্নোর ভাষা শহীদদের পরিচিতি তুলে ধরেন ক্লাবের নির্বাহী সদস্য নাজমুল হোসেন।
প্রধান আলোচক ড. আব্দুল হান্নান “বিলেতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত” শীর্ষক তাঁর সুচিন্তিত দীর্ঘ আলোচনায় বিলেতে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে আমাদের অগ্রজদের অপরিসীম অবদান এবং সেটি ধরে রাখা ও উন্নয়নে আমাদের করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি আরো বলেন- আশির দশকে এখানে যখন বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন আমাদের পুর্বপূরুষরা সরকারি ফান্ডিংয়ের কথা চিন্তা করেননি। তাঁরা তখন সন্তানদের বাংলা শেখানোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন- যদি তাদের বাংলা শেখানো না যায় তাহলে তারা শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই তাঁরা নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে বাংলা স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু আজ সেই স্কুলগুলো সরকারী ফান্ডিংয়ের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজেদের উদ্যোগে সেগুলো চালু রাখতে পারছি না। এটা আমাদের বড় ব্যর্থতা। এখনও সময় আছে- আমাদের সন্তানেরা যাতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে শিকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সে জন্য বাংলা শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে আর ছেলে মেয়েদের বাংলা শিক্ষায় মা বাবাদেরকেই মুখ্য ভুমিকা পালন করতে হবে।
বিবিসি বাংলা’র প্রযোজক মিজানুর রহমান খান বলেন- ভাষা যে শুধু বর্ণমালার সমষ্টি তা নয়, এটি একটি সম্পর্কের ব্রিজ। দেশ, পরিবার ও স্বজনদের সাথে সেই ব্রিজ বা সেতুর সম্পর্ক অটুট রাখতে বাংলা ভাষা শেখা ও চর্চা খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
চ্যানেল এস’র অনুষ্ঠান প্রধান ফারহান মাসুদ খান ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
টিভি ওয়ান এর প্রযোজক ও উপস্থাপক জিয়াউর রহমান সাকলাইন মাতৃভাষা চর্চা না হওয়ায় কীভাবে পরিবারের প্রবীণদের সাথে নতুন প্রজন্মের সম্পর্কে ছেদ সৃষ্টি হচ্ছে তা তুলে ধরেন।
মুল আলোচক ড. মোঃ আব্দুল হান্নানের বক্তব্যের পর মুক্ত আলোচনায় অংশনেন ক্লাবের তিন সাবেক সভাপতি যথাক্রমে সাপ্তাহিক জনমত সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা, জনমত এর সাবেক সম্পাদক নবাব উদ্দিন ও সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ, টিভি উপস্থাপিকা উর্মি মাজহার, চ্যানেল এস’র চীফ রিপোর্টার ও প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ জুবায়ের, সাবেক কোষাধ্যক্ষ আ স ম মাসুম, কবি ছড়াকার দিলু নাসের ও সংস্কৃতিকর্মী নজরুল ইসলাম আকিব।
দ্বিতীয় পর্বে সহ সাধারণ সম্পাদক সাঈম চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন আবৃত্তিকার সালাউদ্দিন শাহীন এবং কবি ও ছড়াকার দিলু নাসের। গান পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পি ববি রায় ও শিশুশিল্পী তানিশা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের শেষদিকে অতিথিদের ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন- লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ সভাপতি ও সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট সম্পাদক তারেক চৌধুরী এবং নির্বাহী কমিটির সকল সদস্যকে সভামঞ্চে আহবান করে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ সালেহ আহমদ।
এছাড়াও অনুষ্ঠানটি সফল করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় ক্লাবের সহ কোষাধ্যক্ষ এম এ কাইয়ুম, মিডিয়া এন্ড আইটি সেক্রেটারি আবদুল হান্নান, ইভেন্ট এন্ড ফ্যাসিলিটিজ সেক্রেটারি রেজাউল করিম মৃধা, প্রথম নির্বাহী সদস্য আহাদ চৌধুরী বাবু, নির্বাহী সদস্য আনোয়ার শাহজাহান ও সরওয়ার হোসেনকে ক্লাবের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
বৈরি আবহাওয়া সত্ত্বেও ক্লাব সদস্য রুপি আমিন, কণ্ঠশিল্পী ববি রায় ও রিনা দাশসহ নির্বাহী কমিটির সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।