নুরুননাহার সাত্তার : সম্প্রতি বাংলাদেশের মেয়েদের মাসিক নিয়ে একটা ভীতিকর লেখা আমায় রীতিমতো আতঙ্কিত করে৷ যে দেশের নারীরা আজ ফুটবল খেলছে, পাইলট হচ্ছে কিংবা এভারেস্ট জয় করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে, সে দেশে নারী স্বাস্থ্য নিয়ে এত অবহেলা?
বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতির পাশাপাশি নারী স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আজকের যুগে এতটা অবহেলা ভাববার বিষয় বৈকি! পত্রিকার ঐ রিপোর্টটিতে বাংলাদেশের একটি গ্রামের মেয়েদের কথা লেখা হয়েছিল৷ যে গ্রামের অধিকাংশ মেয়ে মাসিকের সময় নোংরা কাপড় ব্যবহার করে৷ কেউ বা ব্যবহার করে গাছের পাতা৷ কাপড়ের মধ্যে বালি ভরে মাসিকের রক্ত লুকানোর চেষ্টা করে অনেকে৷ আবার কেউ কেউ কিছুই ব্যবহার করে না৷ এসব অস্বাস্থ্যকর জিনিস ব্যবহারের ফলে শরীরের যে কতটা ক্ষতি হচ্ছে তা গ্রামের কিশোরীরা নিশ্চয়ই জানে না৷ ভাবতে অবাক লাগে এ যুগেও গ্রামের মেয়েদের মাসিক বা পিরিয়ড সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই নেই৷
আবার অন্যদিকে দেখা যায় বাংলাদেশের গ্রামেও আজকাল মেয়েরা আগের মতো ফ্রক থেকে শাড়ি নয়, অনেকেই পরছে সালোয়ার কামিজ বা ম্যাক্সির মতো পোশাক৷ গ্রামের ছেলেরাও কম যায় না৷ লুঙ্গির পরিবর্তে ওদের গায়ে এখন টি-শার্ট আর জিন্স৷ প্রশ্ন হলো- কাপড়ের ক্ষেত্রে আধুনিক হতে পারলেও, মাসিকের সময় স্বাস্থ্যের খাতিরে আমার দেশের মেয়েরা, দেশের মানুষরা আধুনিক হতে পারেনি কেন?
ঋতুস্রাব হলে বলা হয়- মেয়েদের দু’দিন চুল ধোয়া উচিত নয়৷ এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং চিকিৎসকরা বলে থাকেন মাথায় পানি দিলে মাসিকের ব্যথা অনেকটা কমে এবং এতে আরাম পাওয়া যায়।
আসলে মানুষের জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বয়ঃসন্ধিকাল। কিশোরীদের তখন প্রাকৃতিক নিয়মেই শুরু হয় মাসিক বা ঋতুস্রাব, যা খুবই স্বাভাবিক। তবে আগে থেকে জানা না থাকলে একজন কিশোরীর কাছে তা ভয়ের কারণ হতে পারে। সে সময় তার প্রয়োজন একজন ভালো সঙ্গীর। তিনি হতে পারেন মা, খালা, বড় বোন বা বন্ধু। কারণ তখন কোনো ভুল হয়ে গেলে মেয়েটিকে সারাজীবনই ভুগতে হতে পারে। কারণ পিরিয়ডের সময় অনেকরই শরীর এবং পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সময় মতো তার চিকিৎসা করানো না হলে পরে ভয়ংকর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে ‘মা’ হওয়ার ক্ষেত্রে। তাছাড়া মাসিকের সময় কিশোরী মেয়েটি পুরনো কাপড় আর প্যাড- যাই ব্যবহার করুক না কেন, তা কতক্ষণ পর বদলাতে হবে, কী করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে ভালো করে যে শুধু জানা দরকার তাই নয়, মেয়েদের এই বিশেষ সময়টিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাটাও অত্যন্ত জরুরি৷ কারণ স্যাঁতসেতে বা ভেজা কাপড়ে জীবাণু শুধু বাসাই বাধেনা, সেখানে থাকতেও পছন্দ করে। তাছাড়া ঋতুমতি মেয়েদের শুধু শরীরেই পরিবর্তন আসে না, তখন পরিবর্তন ঘটে মনেও।
বহু বছর বিদেশে থাকার কারণেই কিনা জানি না ঢাকায় কোনো পাবলিক টয়লেটে ঢুকতে ভীষণ অস্বস্তি হয় আমার। আর ঢাকার বাইরে মফঃস্বল বা গ্রামে তো মেয়েদের টয়লেটে যাবার কোনো ব্যবস্থাই নেই। অথচ মাসিকের সময় ছাড়াও প্রস্রাব আটকে রাখা মেয়েদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, সেকথা হয়ত গ্রামের মেয়েদের জানা নেই। অবশ্য জানলেই বা কী করবে তারা?
জার্মানিতে মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন জ্ঞান ছোটবেলা থেকেই হয়ে যায়। মাসিক কী, কেন হয়, সে সময় কতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা প্রয়োজন, কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত, মাসিকের ব্যথা নিয়ে অবহেলা করলে পরে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে- এ সব বিষয়ে প্রাইমারি স্কুল থেকেই মেয়েদের একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়া হয়। জার্মানিতে৷ তখন কোন ব্যায়াম করা উচিত, কোনটা নয়, সাঁতার কাটা উচিত কিনা তা ভালোভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয় তাদের। তাছাড়া মায়েরাও তাদের মেয়েদের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করে দেন।
বহু বছর আগের কথা, তবে আমার নিজের ক্ষেত্রে এটুকু মনে আছে যে মাসিক হওয়ার পরই আমি প্রথম জেনেছি সে সম্পর্কে। তবে বড় বোনরা থাকায় ওরাই মায়ের পুরনো কাপড় কেটে ব্যবহার করার নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে, শিখিয়ে দিয়েছিল। এর অনেকদিন পর পরিচয় ঘটে স্যানিটারি প্যাডের সাথে।
জার্মানিতে এসে দেখেছি- এখানে মেয়েদের মাসিক মাথাব্যথার মতোই একটি অতি সাধারণ ব্যাপার, যা নিয়ে ছেলেমেয়ে কারুরই কোনো গোপনীয়তা নেই। তাই এ বিষয়ে আলোচনাও করে তারা অবলীলায়। পিরিয়ডের সময় মেয়েদের মেজাজ যে খানিকটা চড়া থাকে সেকথা ছোট ছেলেমেয়েরাও জানে। সেই মুহূর্তে মায়ের মেজাজের কারণে বিশেষ আবদার যে করা যাবে না, তা তারা নিজেদের মধ্যেই ‘শেয়ার’ করে নেয়। মেয়েদের মাসিক এখানে এতটাই স্বাভাবিক ব্যাপার যে, কোনো মেয়ে চট করে রেগে গেলে বা একটু অন্যরকম আচরণ করলে অন্যরা ধরেই নেয় যে মেয়েটি এখন ঋতুমতি।
জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ডাক্তারের চেম্বার, উঁচুমানের শপিং মল বা পাবলিক টয়লেটগুলোতে মহিলাদের জন্য থাকে স্যানিটারি ব্যাগ এবং আলাদা ডাস্টবিন। এমনকি কিছু জায়াগায় প্যাড এবং ট্যামপন-ও থাকে।
আমার মনে হয়- বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশে এ সব বিষয়ে সরাসরি কথা বলা এবং সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন। মাসিক সম্পর্কে যেসব কুসংস্কার রয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে অনেক আগেই। বলা বাহুল্য, নারীর স্বাস্থ্যের ওপরই নির্ভর করে পুরো পরিবারের স্বাস্থ্য। তাই পরিবারের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে নারীর সহযোগিতায়।