দেশ-বিদেশ নিউজ ডেস্ক : পৈতৃক নিবাস সিলেট জেলার জালালপুর গ্রামে। তবে ইমরানুর রহমানের জন্ম-বেড়ে ওঠা লন্ডনে। নাড়ির টানে দেশে ফিরেই চমকে দেন সবাইকে। ১০০ মিটারে স্বর্ণ জিতে নিজের জাত চেনান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের এ তারকা। স্প্রিন্টে তার পরের গল্পটা কেবলই সাফল্যের। তিনবার দ্রুততম মানব নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য এক উচ্চতায়। বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা মেলে ধরলেন। শনিবার ফের সবাইকে বিস্মিত করে জয়ের কেতন ওড়ালেন কাজাখস্তানে। এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে জিতলেন স্বর্ণপদক। আর এতেই দেশে অ্যাথলেটিকসের ইতিহাস নতুন করে লিখলেন ইমরানুর। বাংলাদেশের হয়ে এমন দুরন্ত কীর্তি নেই যে অন্য কারোর!
প্রিয় মাতৃভূমিকে এশিয়ান অ্যাথলেটিকসে প্রথম স্বর্ণ উপহার দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই যারপরনাই উচ্ছ্বাসের ভেলায় ভাসছেন ইমরানুর। মনের সেই আনন্দটা ঠিক প্রকাশ করার ভাষাই যেন খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকটা নির্বাক এ দৌড়বিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আসলে এই খুশি বা ভালোলাগা অন্যরকম। ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। অনেক দিন ধরেই এমন কিছুর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে সাফল্য ধরা দিয়েছে।’
ইমরানুরের স্বপ্ন এখন আরও অনেক বড়। সাফল্য ছিনিয়ে নিতে চান দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে। চ্যাম্পিয়ন হতে চান এশিয়ান গেমসেও। চোখ রাখছেন অলিম্পিকেও। নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘সামনে আরও ভালো করতে চাই। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশকে স্বর্ণ এনে দিতে চাই। ভালো করতে চাই এশিয়ান গেমসেও। আর অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতায় ভালো করার বড় স্বপ্ন তো অনেক দিনের।’
এখন আরও বড় আসরে ভালো করতে চান ইমরানুর। কাজটা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু সেই পথ বড্ড কঠিন। ইমরানুর নিজেও মানছেন সেই ইস্পাতকঠিন চ্যালেঞ্জের কথা- ‘হ্যাঁ, অনেক কঠিন। আরও ভালো করতে হলে হাইপারফরম্যান্স ট্রেনিং প্রয়োজন। বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই আমাকে অ্যাথলেটিকস নিয়ে কাজ করতে হবে।’
দুর্বার পারফরম্যান্সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তার খুশির দিনে ইমরানুরকে ভালোবাসায় সিক্ত করছেন ভক্ত-অনুরাগীরা। চারদিক থেকে আসা শুভানুধ্যায়ীদের অভিনন্দন বার্তায় রীতিমতো যেন ভেসে যাচ্ছেন এ তারকা গতিবিদ, ‘সবাই বাহবা দিচ্ছেন। স্তুতি গাইছেন। বাংলাদেশ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা পেয়েছি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমে। আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি এটা। এ ছাড়া গণমাধ্যম থেকে শুরু করে অন্যরা তো আছেই।’
লন্ডনে বসবাসরত ইমরানুরের বাবা-মা ও স্ত্রীও বেজায় খুশি। নিজের সাফল্যে পরিবারের সবার প্রতিক্রিয়া নিয়ে এ দৌড়বিদ বলেন, ‘আমার বাবা-মা সব সময় চান দেশের জন্য যেন কিছু করি। তাই তো দেশের হয়ে খেলতে ২০২১ সালে প্রথম ঢাকায় আসি। সেই স্বপ্নটা এবার পূরণ হয়েছে। প্রথমবারের মতো পদক জিতেছি। বাবা, মা অনেক খুশি। বাদ পড়ছে না স্ত্রীসহ অন্যরাও।’
কাজাখস্তানে যে স্বর্ণপদক জিতবেন, এমনটি ঠিক কল্পনাও করেননি ইমরানুর- ‘কাজাখস্তানে ভালো করার লক্ষ্য নিয়েই এসেছি। তবে এতটা ভালো করতে পারব কখনও প্রত্যাশাই করিনি। এখানে শুরু থেকে ভালো করছিলাম, হিটে প্রথম হই। সেমিফাইনালে ফটো ফিনিশে হই দ্বিতীয়। ফাইনালেও আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। জানতাম নিজের সেরাটুকু উজাড় করে দিতে পারলে ভালো কিছু হবে। ঠিক তাই হয়েছে। আমি আসলে ভীত ছিলাম না।’
দৌড়ে জাপান, কাতার, ভারত ও চীনের অ্যাথলেটদের হারিয়ে প্রথম হয়েছেন। স্বর্ণ জয়ের পর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটরাও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন ইমরানুরের, ‘আমি প্রথম হওয়ায় ওরা তো অবাক। বাংলাদেশের হয়ে স্বর্ণপদক জিতব এটা হয়তো ভাবেননি তারা। দৌড় শেষে তারা অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রশংসাও করেছেন।’
শুরুতে ফুটবল খেলতেন। স্কুল পর্যায়ে পুরোদমে চালিয়ে গেছেন ফুটবল খেলা। ১৬-১৭ বছর বয়সে এসে ইমরানুর হঠাৎই অনুভব করেন অ্যাথলেটিকসের প্রতি ভালোবাসা। সেই টানেই ফুটবল ছেড়ে বেছে নেন অ্যাথলেটিকস, ‘দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকদের জন্য ইংলিশ ফুটবলে ভালো করা খুব দুরূহ। এ কারণে ফুটবল বাদ দিয়ে অ্যাথলেটিকস নিয়ে কাজ শুরু করি। এখন একরকম সফল বলতে পারেন আমাকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে পদক উপহার দিতে পেরেছি।’
লন্ডনের শেফিল্ডে দুটি চাকরি সামলাতে হয় ইমরানুরকে। তারপরই অনুশীলন করেন অ্যাথলেটিকসে। পুরোদমে অ্যাথলেটিকসে মনোযোগ দিলে চাকরি করা কঠিন। সেই চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে নিয়ে ইমরানুর জানান, স্বপ্নের অ্যাথলেটিকস থেকে একচুলও সরবেন না, ‘হ্যাঁ, তা তো হবেই। ভালো করতে চাইলে পুরোদমে মনোযোগ দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এখন চাকরি, জিম ও অনুশীলন একসঙ্গে করতে হয়। অবসর পাই না বললেই চলে। লন্ডনে আমার কোচ আছে। তার অধীনেই অনুশীলন করি। এজন্য খরচও ঢের। তবে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন আমার এ বিষয়টি দেখছে। আশা করছি, কিছু একটা সমাধান হয়ে যাবে। কারণ হাইপারফরম্যান্স অনুশীলন ছাড়া আরও বড় পদক জেতা দুঃসাধ্য। যেমন শ্রীলঙ্কার অ্যাথলেট আবেকুন ইতালিতে দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন সুযোগ আমাদেরও প্রয়োজন।’
ট্র্যাকে দুর্বার পারফরম্যান্স দেখিয়েও যেন সন্তুষ্ট নন ইমরানুর। এখনই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন না। দেশের হয়ে ফের ঝলক দেখাতে চান। চান নিজের ও দেশের মুখ আরও উজ্জ্বল করতে। পদক জিততে চান আর বড় কোনো আসরে। এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসের সাফল্যই এখন তাকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগাচ্ছে।