দেশ-বিদেশ নিউজ ডেস্ক : আল থুমামা স্টেডিয়ামে শেষ বাঁশি বাজতেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো হাঁটা দিলেন টানেলের দিকে। সতীর্থরা যখন মাঠে, তখন সিআরসেভেন খুঁজছেন আড়াল। নয়ন ভাসছে জলে। হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢাকার চেষ্টা করছেন। এই দৃশ্য মুহুর্তেই ভেঙে দিয়েছে ফুটবল ভক্তদের হৃদয়।
মরক্কোর কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে ১ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় পর্তুগাল। পর্তুগীজদের স্বপ্নভঙ্গের রাতে কোটি ফুটবল ভক্তের হৃদয় ভেঙে দেয় রোনালদোর চোখের জল। আগ্রাসী রোনালদোর বিশ্বকাপ থেকে এমন বিদায় হয়তো চায়নি কেউই। প্রতিদ্বন্দ্বী ভক্তদেরও হৃদয় কেঁপেছে এমন হাহাকার করা দৃশ্য দেখে।
আফ্রিকান দেশ হিসেবে মরক্কো যখন বুনো উল্লাসে মত্ত ক্যামেরার লেন্স তখন রোনালদোর দিকে তাক করা। টানেল দিয়ে হনহন করে ছুটছেন , সঙ্গে একজন নিরাপত্তারক্ষী। তার কান্না যেন থামছিলই না।
৩৭ বছর বয়সী রোনালদো তার এই বিশ্বকাপ ভুলে যেতে চাইবেন নিঃসন্দেহে। শুধু বিশ্বকাপ নয় এই বাইশ সালে রোনালদো হারিয়েছেন সন্তান, এক বিস্ফোরক সাক্ষাতকার দিয়ে তার জাগরণের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে ঘটেছে বিচ্ছেদ, ম্যানইউ ম্যানেজারের সঙ্গে হয়েছে বিবাদ, খেলেছেন ইউরোপা কাপ, যার ছোঁয়া লেগেছে নিজ দেশের হয়ে খেলার সময়েও।
গোল দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু হলেও পরের যাত্রা ছিল বিষাদময়। বসে থাকতে হয় বেঞ্চে। নামতে হয় বদলি ফুটবলার হিসেবে। এই নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। বিবৃতি দিতে হয় পর্তুগাল ফুটবল ফেডারেশনকেও। লিখেন রোনালদো নিজেও। কিন্তু রোনালদো ভুলতে কি পারবেন সহজে? আকাশ থেকে কিভাবে মাটিতে নামতে হয়, নক্ষত্রের কিভাবে পতন হয় রোনালদো দেখে ফেলেছেন কাতারে কাটানো এই কয়দিনে।, এই বাইশে। যার গায়ে আন্তর্জাতিক পুরুষ ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের তকমা, যিনি দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলেছেন, ১৮ বছর ধরে যিনি দেশের জার্সিতে কতৃত্ব দেখিয়ে গিয়েছেন, যার নাম শুনলেই প্রতিপক্ষের বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারের কাঁপুনি হতো, যিনি গোলরক্ষকদের যমদূত ছিলেন তার কি বেঞ্চে থাকা মানায়? রোনালদোও মানতে পারেননি।
তবুও ফুটবলের স্বার্থে দেশের স্বার্থে বেঞ্চড রোনালদোকে অনেকেই মেনে নিয়েছিল। রোনালদো যে বিষয়টি হজম করতে পারেননি এটি বলে দেয় তার অভিব্যাক্তি। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে তার পরিবর্তে নামা রামোস হ্যাটট্রিক করে অভাববোধ করতে দেননি। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে সেই রামোসের পা জোড়া কথা বলেনি। রোনালদো আসেন ম্যাচের ৫০ মিনিটে। ততক্ষণে পিছিয়ে আছে দল। রোনালদো শেষ পর্যন্ত গোল দিতে পারেননি। একমাত্র ফুটবলার, যিনি ৫টি বিশ্বকাপে গোল করেছেন, তিনি আবার নকআউট পর্বে একটি গোলও করতে পারেননি। নিজের শেষ বিশ্বকাপেও নকআউটের সেই খরা কাটাতে পারেননি।
এই বিশ্বকাপ ছিল রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপ। হয়তো পর্তুগীজ জার্সিতে খেলে ফেলেছেন শেষ ম্যাচটিও। কে জানে রেফারির শেষ বাঁশির সঙ্গে দেশের জার্সিতে রোনালদোর দেরযুগের যাত্রাও থেমে। ২০০৩ সালে অভিষেকের পর থেকে তিনি দেশের হয়ে খেলেন ১৯৬ ম্যাচ। বিশ্বফুটবলে যা যৌথ রেকর্ড। শুধু তাই নয় সর্বোচ্চ ১১৮ গোলের রেকর্ডও তার। কিন্তু দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ তাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে খালি হাতে। ক্লাব ফুটবলে সর্বোচ্চ সাফল্য দেখা রোনালদোর দেশের হয়ে একমাত্র ট্রফি ইউরোর। কতশত অর্জনের মাঝে রোনালদোর জীবনে আক্ষেপ হয়ে থাকবে এটি।
ইতি টানা যাক রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা দিয়ে…
‘বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে,
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো।
আজি মধু সমীরণে নিশীথে কুসুমবনে
তারে কি পড়েছে মনে বকুলতলে।’
বকুলতলে রোনালদো মনে পড়েবেন না ঠিক, বিশ্বকাপের মঞ্চ তাকে ছাড়া কিছুটা শুন্যই মনে হবে!