সোহেল আহমদ চৌধুরী, বার্মিংহাম প্রতিনিধি : প্রবাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম মিসেস বদরুন্নেসা পাশা এম বি ই আর আমাদের মাঝে আর নেই। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে শনিবার বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে জাগতিক পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ইন্নালিল্লাহী ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মিসেস পাশা ছিলেন “বার্মিংহাম বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির আহবায়ক জগলুল পাশার সহধর্মিণী। মিসেস বদরুন্নেসা পাশা এমবিই ছিলেন একজন ভাল সংগঠক, তিনি ছিলেন বার্মিংহাম উইম্যান অ্যাসোসিয়েশনের নেত্রী। যার হাত ধরে স্মলহীথের কভেনট্রি রোডে নিজস্ব ভবনে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ মহিলা কর্মসংস্থান নামক একটি সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান। ইংরেজী ভাষা শিক্ষা ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যার সুফল দীর্ঘদিন থেকে ভোগ করতেছেন দেশ থেকে আসা নতুন মহিলারা। স্বামী জগলুল পাশা অ্যাকশন কমিটির নেতা ছিলেন, নিজে নারী নেত্রী হওয়ার সুবাদে বার্মিংহামের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন প্রতিবাদ সভা, আন্দোলন সংগ্রাম ও স্বাধীনতার পক্ষে জনগণের মধ্যে জনমত গড়ে তুলতেন তিনি।
পাকিস্তানিদের রক্তচোখ উপেক্ষা করে বার্মিংহামের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষেও কাজ করেছেন তিনি। আপামর জনগণের সাথে কাঁধ মিলিয়ে অকুতোভয় সৈনিকের মত কাজ করে গেছেন পাশা দম্পতি। ১৯৭১ সালে “বার্মিংহাম বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি” পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে সবার সাথে কাজ করতে যেয়ে মিঃ জগলুল পাশা ও মিসেস বদরুন্নেসে পাশা এমবিই তাঁদের দেশ প্রেম ও নিঃস্বার্থ কাজের জন্য বার্মিংহামবাসি তথা সাড়া বৃটেনের মানুষের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রবাসে বাঙালিদের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে জনমত আদায়ে পাশা দম্পতি সবার সাথে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন মিছিল মিটিং অগ্রভাগে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাতদিন কাজ করেছেন । স্মলহীতের ওয়াসওয়ার্থ রোডের বাসাটি তখন ছিল স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল মানুষের মিলনস্থল। সকল কর্ম পদ্ধতি, সকল কর্মকান্ড, প্রতিবাদ আন্দোলনের পরিকল্পনা, এই বাসায় বসে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিতেন। সকল আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন পাশা দম্পতি সাহসী জননী অকুতোভয় সৈনিকের মত।
বার্মিংহামের ঐতিহাসিক স্মলহীত পার্কে “বার্মিংহাম বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির” ডাকে ১৯৭১ সালের ২৮ই মার্চ বিশাল জনসভা ও পতাকা উত্তোলন ও শপথ সভার আয়োজন করা হয়। ঐ প্রতিবাদ সভায় বহিঃবিশ্বে ঢাকার পর প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন বার্মিংহাম ও বৃটেনের বিভিন্ন শহর থেকে আসা হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ। পতাকা উত্তোলন ও শপথ শেষে জনগণের উদ্দেশ্যে নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। নারী নেত্রী হিসাবে ঐ দিনের বিশাল জনসভায় মিসেস বদরুন্নেসা পাশা এমবিই আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে বৃটেনের বিভিন্ন শহর থেকে আসা মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। তহবিল সংগ্রহে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে নিজের বিয়ের স্বর্ণের গহনা দেশের জন্য দান করে সবাইকে উৎসাহিত করেন। মিসেস পাশার এই সাহসী উদ্দ্যোগ অনেককে উৎসাহিত করে এবং তহবিল সংগ্রহে অনেক সহায়তা করে। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সরকার তাঁর বিয়ের গহনা দেশের জন্য দান করে বিদেশের মাটিতে জনগণকে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহিত করার জন্য প্রশসংসা পত্র পর্যন্ত দেন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ ।
বৃটেনের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে এত বড় প্রতিবাদ সভা আন্দোলন তার জন্যই সম্ভব হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার পর দশ হাজার মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতে পতাকা উত্তোলন শপথ পাঠ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাকিস্তানি সংখ্যাগরিষ্ট বাসিন্দার জায়গা বার্মিংহামের স্মলহীথ পার্কে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহন করে তা সাড়া বৃটেনে ছড়িয়ে দিতে যে মানুষ গুলো নিজের জীবনবাজি রেখে শত বাঁধার মুখে। সরাসরি স্মলহীথ পার্কে হানাদার পাকিস্তানিদের দ্বারা শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হয়ে কিছু মানুষ আহত হয়ে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছে । ১৯৭১ সালে ২৮ই মার্চ যারা বক্তব্য দিয়ে ছিলেন আহবায়ক জগলুল পাশা ছাড়া ঐ সময়ের ইংরেজিতে তুখোর বক্তা টনি হক যিনি ট্রাফলগার স্কুয়ারেও বক্তব্য রেখে ছিলেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় অত্যন্ত ভাল সংগঠক আফরুজ মিয়া, সবুর চৌধুরী, মিসেস বদরুন্নেসা পাশা এমবিই প্রমুখসহ যারা শত বাঁধার পরও এই আন্দোলনকে সাড়া বৃটেনে ছড়িয়ে দিলেন।
বর্তমান সরকার লন্ডনের গুটি কয়েক ব্যক্তিকে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বা মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে সম্প্রতি স্বীকৃতি দিলেও আমরা জানিনা কোন অদৃশ্য ইশারায় যারা এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, সাড়া বৃটেনের বাঙালিদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিলেন। আজ ৫২ বছর পরও তাঁদেরকে কেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বা মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে কোন স্বীকৃতি সরকার দেয়নি। মিসেস বদরুন্নেসা পাশা এমবিইসহ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনমত ও তহবিল সংগ্রহে যে সকল সংগঠক ও কর্মী। পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে আহত হয়ে জেলে যাওয়া মরহুম চান মিয়া ও ইব্রাহিম আলীসহ অনেকে আক্ষেপ নিয়ে দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিলেন।.তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহকদের শুভদৃষ্টি আর তাঁদের উপর পরলো না। সেই আক্ষেপ নিয়ে দুরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে লড়াই করতে করতে নির্ভয়া বিদুষী আমাদের সাহসী জননী মিসেস পাশা একবুক অভিমান নিয়ে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ১৯৭১ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে বুকে লালন করেছেন আর সেই বিশ্বাস রেখেই চির বিদায় নিলেন নির্ভয়া বিদুষী এ নারী।
উল্লেখ্য যে বার্মিংহামে বাঙালি কমিউনিটি ও অন্য কমিউনিটিতে বিভিন্ন সেবা মূলক কাজের জন্য বৃটেনের মহামান্য রাণী তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসাবে গত বছর উনাকে এম বি ই খেতাবে সম্মানিত করেন।