দেশ-বিদেশ নিউজ ডেস্ক : আজ ঐতিহাসিক ২৫ মার্চ। মহান মুক্তিযুদ্ধের শোকস্মৃতিবাহী গণহত্যা আর নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞের ‘কালরাত’। জাতীয় ‘গণহত্যা দিবস’। জাতি গভীর বেদনায় প্রতিবছর স্মরণ করে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাপুরুষোচিত হামলার শিকার নিরীহ শহীদ আর প্রতিরোধসংগ্রামে আত্মদানকারী বীর যোদ্ধাদের।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে আজ রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) ও জরুরি স্থাপনাগুলো এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে দিবসটির ৫৩ বছর পূর্তিতে আজ রাত ৯টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ৫৩টি মশাল প্রজ্বালন করবেন এবং আলোর মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়করা, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা। আলোর মিছিলের শুরুতে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের স্মরণে সংক্ষিপ্ত আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এদিন দেশে ও বিদেশে নির্মূল কমিটির সব শাখা শহীদদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাসংগ্রামে শহীদ ও গণহত্যায় নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে।
তার আগে সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনাসভা হবে। সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণা ও আলোচনাসভা হবে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনাসভা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ বিকেল ৩টায় একাত্তরের ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার এবং গণহত্যায় জড়িত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করবে। ঢাকায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই কর্মসূচি পালন করা হবে।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চে রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে বিকেলে ঢাকা থেকে পালিয়ে যান। বাংলা তখন অগ্নিগর্ভ। উত্তাল দিন শেষে ঘনিয়ে আসে আঁধার। বাঙালি জানতে পারেনি কী ভয়ংকর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত নামছে তাদের জীবনে।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র মানুষের ওপর। পাকিস্তানি সেনারা হামলে পড়ে পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও সংলগ্ন এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা ইপিআর (পরে বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) হেডকোয়ার্টার্স ও আশপাশের এলাকায়। কারফিউ জারি করা হয়। জনবসতিতে দেওয়া হয় আগুন। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। হতচকিত নিরস্ত্র মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে ওঠে লাশের শহর। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার বুকে এক রাতের এক সামরিক ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অপারেশনে কী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, বিশ্ববাসী প্রথমে তা জানতে পারেনি। নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ এক প্রতিবেদনে জানায়, সেই রাতে নিহত হয়েছে ১০ হাজার মানুষ। কিন্তু ১ এপ্রিলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও ওই রাতেই গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এর আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান, যার প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার প্রত্যয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এরপর রাজনৈতিক কর্মী, বাঙালি সৈনিক আর সাধারণ মানুষের সম্মিলিত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, বিপুল প্রাণহানি আর ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় স্বাধীনতার সূর্য। ২০১৭ সাল থেকে আজকের দিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।