দেশ-বিদেশ নিউজ ডেস্ক : তাইওয়ানের ভূখণ্ড ও আশেপাশের জলসীমায় গুরুত্বপূর্ণ সব লক্ষ্যে নিখুঁত হামলার মহড়া চালিয়েছে চীন। তাইওয়ানকে ঘিরে বেইজিং তিনদিন ধরে যে সামরিক মহড়ার কথা ঘোষণা করেছে আজ রবিবার তার দ্বিতীয় দিন। এই মহড়াকে চীন স্বশাসিত এই দ্বীপটির প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি বলে উল্লেখ করেছে। গত সপ্তাহে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের যুক্তরাষ্ট্র সফরের জবাবে বেইজিং এই মহড়া চালাচ্ছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, এই মহড়ায় সামরিক বাহিনীর দূর-পাল্লার রকেট, নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার, ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ, বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান, বোমারু বিমান, জ্যামারসহ আরো অনেক অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনের সামরিক বাহিনী যখন তাইওয়ান দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলার এই মহড়া পরিচালনা করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বেইজিংয়ের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহবান জানানো হয়েছে।
এই মহড়ায় চীনের ৯টি যুদ্ধজাহাজও অংশ নিচ্ছে। চীন এই মহড়ার নাম দিয়েছে ‘জয়েন্ট সোর্ড’, যা চলবে আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত। মহড়ার প্রথম দিন চীনের একটি যুদ্ধজাহাজ পিংটন দ্বীপের কাছে অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে ফায়ার করেছে। চীনের এই দ্বীপটি তাইওয়ানের সবচেয়ে কাছের। তাইওয়ানের উপকূল রক্ষী বাহিনীকে পরিচালনা করে যে ওশান অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল, তারা একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তাদের একটি জাহাজ চীনা যুদ্ধজাহাজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। তবে সেটি কোথায় হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি।
এই ফুটেজে একজন নাবিককে চীনা যুদ্ধজাহাজের উদ্দেশে রেডিওতে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আপনারা আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তার বড় ধরনের ক্ষতি করছেন। অনুগ্রহ করে এখনই ঘুরে এখান থেকে চলে যান। আপনারা যদি আরো অগ্রসর হতে থাকেন, তাহলে আপনাদেরকে এখান থেকে বিতাড়িত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ আরেকটি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ানের একটি যুদ্ধজাহাজ দি হুয়া কোস্ট গার্ডের একটি জাহাজের পাশাপাশি চলছে। কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তারা এই ঘটনাকে চীনা নৌযানের সঙ্গে ‘অচলাবস্থা’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রথম দিনের মহড়া শেষ হয় শনিবার সন্ধ্যায়। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, রবিবার সকাল থেকে চীনা যুদ্ধবিমানের মহড়া পুনরায় শুরু হয়।
তাইওয়ানের ক্ষোভ
চীনের এই সামরিক তৎপরতায় তাইওয়ানের কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শনিবার তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তাদের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে এই ‘সামরিক মহড়ার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে ওই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে’। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা চীনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, তারা যেন এই মহড়ার কারণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট সাইয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে ব্যবহার না করে। একই সঙ্গে তারা ‘স্থিতাবস্থার পরিবর্তন না ঘটানো এবং সংযম প্রদর্শনেরও’ আহবান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘চীন কী করছে তার ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখা হচ্ছে’ এবং ‘ওই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতি বজায় রাখাসহ জাতীয় নিরাপত্তার অঙ্গীকার রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট উপকরণ এবং ক্ষমতা রয়েছে’।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৯ সালে বেইজিংয়ের স্বার্থে তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে আইন অনুসারে তারা তাইওয়ানকে রক্ষার ব্যাপারে সাহায্য দিতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বেশ কয়েকবারই বলেছেন, চীন যদি তাইওয়ানকে আক্রমণ করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই বার্তা খুব বেশি স্পষ্ট নয়। তাইওয়ানের প্রতি ‘অব্যাহত সমর্থনের’ জন্য প্রেসিডেন্ট সাই বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে হাউজ স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘এর ফলে তাইওয়ানের জনগণ যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি এবং আমরা যে একা নই এ বিষয়ে জনগণ পুনরায় আশ্বস্ত হয়েছে।’
তাইওয়ান নিজেদেরকে একটি সার্বভৌম দেশ বলে গণ্য করে। তাদের আছে নিজস্ব সংবিধান ও নির্বাচিত সরকার। কিন্তু চীন মনে করে, তাইওয়ান তাদের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ। এক সময় এটি বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং এ জন্য প্রয়োজনে তারা শক্তি প্রয়োগ করতেও প্রস্তুত। চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংও পুনরেকত্রীকরণের কথা বলে থাকেন।
গত বছরের আগস্ট মাসেও চীন তাইওয়ানের চারপাশ ঘিরে এক সপ্তাহের মহড়া শুরু করেছিল, যখন সাবেক মার্কিন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরে গিয়েছিলেন। সেটি ছিল বিগত বছরগুলোতে চীনের সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী। মহড়ার সময় যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
তবে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের বাসিন্দারা চীনের সর্বশেষ এই সামরিক মহড়া নিয়ে খুব একটা বিচলিত নন। জিম সাই নামে এক বাসিন্দা শনিবার বলেন, ‘আমার মনে হয় তাইওয়ানের অনেক মানুষই এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা মনে করছে, এরকম একটা ঘটনাই আবার ঘটছে।’ উল্লেখ্য, তাইওয়ানের মর্যাদা ১৯৪৯ সাল থেকে অস্পষ্ট। চীনে দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পর ওই বছরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে এবং সরকারি নেতারা এই দ্বীপটিতে পালিয়ে যায়।